যুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, বাড়ছে দক্ষতা। এই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে অনেকেই ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে আয় করছেন। কোন নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কাজ না করেও আয় করছেন ফ্রিল্যান্সার রা, বাংলাদেশে বসেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আয়ের পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সার দের বাড়ছে দক্ষতা।
অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন আউটসোর্সিং এ । দেশের অনেক তরুণ আউটসোর্সিং করে সৃষ্টি করেছেন দৃষ্টান্ত। তাদের দেখে নতুনদের মধ্যেও তৈরি হচ্ছে আগ্রহ। কিন্তু কী করতে হবে? কীভাবে করতে হবে? এমন অনেক কিছু প্রশ্ন নতুনদের।
নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন ফ্রিল্যান্সার দের জন্য লিখেছেন বাংলাদেশি সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকার রিসার্চার অ্যান্ড ডেভলপার সুদীপ্ত কর।
নিজেকে প্রফেশনাল ভাবুন
ফ্রিল্যান্সিংয়ের মার্কেটে নিজেকে পুরাদমে প্রফেশনাল ভাবুন। তেমনভাবেই আচরণ করুন। যেমনটা করপোরেট কাজের ক্ষেত্রে করতে হয়। আপনার মূল টার্গেট আপনার স্কিলসেট অনুযায়ী কাজে বিড করে ক্লায়েন্টকে খুশি করে সময় মতো কাজটা সেরে ডলারসহ পাঁচতারা রেটিং নেয়া। একই ক্লায়েন্টের সঙ্গে কাজ করতে করতে ভালো ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক তৈরি হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। সুতরাং যখনই প্রথম কাজটা পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় তখন ‘অ্যাক্ট ক্লিন’। সোজাসাপটা কথা বলুন। আপনার কথা যেন আপনার মুখের চাইতে আপনার প্রোফাইল, কাজের এক্সপেরিয়েন্সটা বেশি বলে।
ক্লায়েন্টকে শুধু ক্লায়েন্টই ভাবুন
ক্লায়েন্টকে শুধু ক্লায়েন্টই ভাবুন এবং মাথায় রাখুন আপনাকে সে কাজ দেবে। সুতরাং তার কথাবার্তার ধরণ বুঝে সেই অনুযায়ী কথা বলুন। তার সাথে খোশ গল্প করতে যাবেন না। আপনার হাতে অগাধ সময় থাকতে পারে, সবার হাতে নেই। উপরন্তু ক্লায়েন্ট বিরক্ত হয়ে কাজ নাও দিতে পারেন।
বাংলাদেশের রেপুটেশন নষ্ট করবেন না
এই লেখাটা মূলত শুরু করেছি ওডেস্কে একটা জব পোস্ট দেখে, সেখানে প্রথম ৩ জন আবেদনকারী দেখে। জব পোস্টটা বিগ ডাটা, হাডুপ এক্সপার্ট নিয়ে (কম্পিউটার সায়েন্সের বাইরের লোকদের বোঝার কথা না। বেশ অ্যাডভান্সড লেভেলের কাজ)। প্রথম ৩ জন আবেদনকারীর প্রোফাইল, আগের কাজ দেখে চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় এরা পারবে না। আন্দাজে বিড করেছে। ৪র্থ জন বাংলাদেশের দেখেই আঁৎকে উঠলাম। উনিও প্রথম ৩ জনের মতোই ওয়েব ডিজাইন, ডেভলপমেন্টের কাজ করে থাকেন এবং এই পোস্টে বিড করছেন।
ভুলেও এমন করবেন না। যে কাজের এটলিস্ট ৮০ ভাগ বোঝেন না, সেটাতে বিড করার দরকার নাই। জব ডেসক্রিপশন খারাপ হলে অন্য ব্যাপার। মাথায় রাখবেন আপনি একজনের জন্য দেশের বাকিদের বদনাম হবে। অনলাইনে ইন্ডিয়ানরা স্প্যামার হিসাবে পরিচিত। দয়া করে বাংলাদেশের রেপুটেশন এভাবে নামাবেন না। আপনি যেই কাজ পারবেন সেটাতেই বিড করুন।
গত বছর রাত ২টার মতো বাজে। মাত্র একটা কাজ পেলাম। খুশী মনে ঘুমাতে যাবো এমন সময় একটা জব পোস্ট দেখলাম Need a corona developer argent today। কী জানি কি মনে করে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি বাংলাদেশের ক্লায়েন্ট, পেমেন্ট সিস্টেম ভেরিফাইড না, হিস্টোরি নাই কোনো। মাথায় এলো নিশ্চয়ই বিপদে পড়ে পোস্ট করেছেন, পেমেন্ট দেয়ার জন্য কার্ড আছে কিনা কে জানে। ডেসক্রিপশন দেখে বুঝলাম ৫-১০ মিনিটের কাজ। মনে করলাম বিপদে পড়লে টাকা ছাড়াই কাজ করে দেব। এত রাতে নিশ্চয়ই কোনো ক্লায়েন্টের কাজ করতে বসে বিপদে পড়েছেন। তাকে মেসেজ দিলাম, স্কাইপিতে এলেন। তার হাতে অনেক কাজ আছে, অনেক টাকা দেবে এমন অনেক কিছু। আমি টাকার কথা না বলে কাজের কথা জানতে চাইলাম। বললাম কোডটা দিতে। কোড দিয়ে সেই লোক বললেন, আধা ঘণ্টার মধ্যে করে দিতে পারলে ৫০ ডলার বোনাস দেবে। আমি কোডটা ঠিক করে পাঠালাম এবং সে স্কাইপি থেকে ব্লক করে দিলো আমাকে। আমি টাকা চাই নাকি চাই না সেটা আমার ব্যাপার। কিন্ত এপ্রোচের একটা ব্যাপার থাকে।
কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ান একটা ক্লায়েন্টের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে কাজ নিয়ে। সে ইন্ডিয়ান আর পাকিস্তানিদের ওপর বিরক্ত। এই দুই দেশের দুইজনকে নাকি এডভান্স টাকা দিয়েছিলেন, তারা কাজ না করে টাকা মেরে দিয়েছে। কাজও ছিল আর্জেন্ট।
নিজের দক্ষতা বাড়ান
প্রতিনিয়ত নিজের দক্ষতা বাড়াতে হবে। আজকে হয়তো আপনার টার্গেট ছোটছোট লোগো বানিয়ে দেয়া। বিনিময়ে ৩-৫ ডলার পাবেন। যদি ছবি ভালো আঁকতে পারেন তাহলে মোবাইল গেমের গ্রাফিক্স বানানোর দিকে নজর দিতে পারেন। বর্তমানে প্রচুর চাহিদা। ভালো আঁকতে পারলে চার পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটা সিম্পল স্কেচপ্যাড কিনে কাজ শুরু করে দিতে পারেন। তবে এর আগে শিওর হয়ে নিন পারবেন কিনা। না হলে শুধু শুধু টাকা নষ্ট করার মানে নাই। অথবা ওয়েবসাইট ডিজাইন, ক্রিয়েটিভ ডিজাইনের অনেক কাজ থাকে। নিজে আগে দুই একটা এক্সপেরিমেন্ট করেন, প্রোফাইলে যুক্ত করুন। ভালো হলে কাজ পাবেন। ফিলিপাইনের অনেক ছেলেমেয়ে মোবাইল গেমের গ্রাফিক্সের চমৎকার কাজ করে।
সৎ থাকুন, প্রতিদান পাবেন
সততা মহৎ গুণ, এটা ভুলবেন না। ছোট স্টেপ দিয়েই শুরু করুন না, আস্তে আস্তে বড় হবে। আপনি ঠিক যা ডিজার্ভ করেন, ঠিক তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন। অন্যকে বোকা বানাতে যাবেন না। আপনি যখন একটা মাইলস্টোন পেমেন্ট নিয়ে কাজ কমপ্লিট না করে ভেগে যাবেন, তখন সেই ক্লায়েন্ট বাংলাদেশের আর কাউকে কাজ দেবে না। হয়তো পোস্টেই লিখে দেবে, No Bangladeshi please. আপনি একা অনেক লোকের ভাত মেরে দিলেন। এগুলির প্রতিদান কোনো না কোনোভাবে কিন্তু আপনাকেই ভোগ করতে হবে। তাই সততা বজায় রাখুন।
নিজেকে তুলে ধরুন
সম্ভব হলে বিড করার আগে বা ইন্টারভিউ পর্বে ক্লায়েন্ট সম্পর্কে জেনে নিন। ক্লায়েন্টের নাম, ধাম গুগলে সার্চ দিন। ইন্ডিয়ানদের থেকে সাবধান থাকা ভালো। অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করাবে, টাকা নিয়ে ঝামেলা করবে। লিংকডইনে প্রোফাইল পেলে সেটা দেখে ক্লায়েন্ট কি কি জানে, কি কি জানে না সেটা বুঝুন। নিজে যা পারেন তা স্মার্টলি প্রেজেন্ট করুন বিড করার সময়। নেট ঘেঁটে সুন্দর একটা কভার লেটার বানিয়ে ফেলুন। যেটা পড়লে যে কেউ আপনার সম্পর্কে ক্লিয়ার ধারণা পাবে। বিভিন্ন পোস্টে বিড করার সময় এটাতে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করে পাঠিয়ে দিন। জব পোস্ট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ুন। অনেক সময় ক্লায়েন্ট স্প্যাম ঠেকানোর জন্য বলে কোনো একটা ওয়ার্ড দিয়ে কভার লেটার শুরু করতে। এগুলি খেয়াল করুন।
আপনি যদি স্টুডেন্ট হন (বিশেষ করে ১ম থেকে ৩য় বর্ষ কম্পিউটার সায়েন্স) তাহলে আপনাকে আমি ডিসকারেজ করবো এখন ফ্রিল্যান্সিং করুন। ছাত্র অবস্থায় অনেক কিছু শেখার আছে, কর্মজীবনে গেলে শেখার সুযোগ হবে না।
ব্যক্তিগত আলোচনা করবেন না
কয়েক সপ্তাহ আগে ইমার্জেন্সি একটা গ্রাফিক্সের কাজ দরকার হওয়ায় রাতের বেলায় ওডেস্কে ছোট্ট একটা জব পোস্ট দেই। বাংলাদেশি কয়েকজনকে বিড করতে দেখে প্রথমজনকে মেসেজ পাঠাই কাজের ডিটেইলস দিয়ে। উত্তর আসে একটা ওয়ার্ড মাত্র। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বের করলাম যে এটা তার স্কাইপি আইডি। এড করলাম। কনভারসেশনের প্রথম লাইনে সে প্রশ্ন করলো, আমি কী করি? এভয়েড করে কাজের কথায় এলাম। সে কনফিডেন্টলি বললো, কাজটা তার হাতের ময়লা। করতে পারবে। তারপরই আবার প্রশ্ন, আমি কই থাকি, কী করি, ফোন নম্বরটা যাতে দেই, মাসে কত টাকা কামাই, ফেসবুক আইডি ইত্যাদি।
এবার কাজের কথায় এলাম। তাকে ডক পাঠালাম কী করা লাগবে এটা দেখিয়ে। সে ১০ মিনিট পরে বললো পারবে না, স্যরি। তারপর স্কাইপি থেকে রিমুভ করে দিলো। এরপরের জনকে স্কাইপিতে আনার পরে দেখি সেও একই ব্যক্তিগত আলোচনা শুরু করলো।
এমন ব্যক্তিগত আলোচনা থেকে বিরত থাকুন। নিজেকে পেশাদার ভাবুন। ব্যক্তিগত আলোচনার কারণে ক্লায়েন্ট বিরক্ত হয়ে আপনাকে কাজ নাও দিতে পারে।
সবশেষে নিজের ওপরে বিশ্বাস রাখুন। স্কিল বাড়ান। নতুন নতুন কাজ শিখুন। মজাও পাবেন। সেই সাথে আর্থিক সুবিধাও হবে। চেষ্টা রাখবেন নতুন কিছু শেখার। এক কাজে টাকা চলে এলে সেটা নিয়েই পড়ে থাকবেন না। অন্য কাজে আরো বেশি টাকাও পেতে পারেন।